সাভার প্রতিনিধি : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকার অদূরে সাভারে ১১ জন নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র, ভিডিও এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দেওয়া তথ্যে এ নিহতের বিষয়ে জানা গেছে। তবে পুলিশের তথ্যে কোনো হতাহত নেই। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ঘরে দেড় বছরের শিশু ইভান পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। অন্যদিকে এনজিও কর্মী কিস্তির তাগাদায় দরজায় খটখট করছে। বাহিরে চলছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। ক্ষণে ক্ষণেই গোলাগুলির শব্দ ঘর থেকেই কানে আসত। গুলির শব্দ উপেক্ষা করে ইভানের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে ২০ জুলাই শনিবার দুপুরে অটোরিকশা নিয়ে বের হন রনি প্রামাণিক (২৮)। সাড়ে ৫টার দিকে পরিবারের কাছে খবর আসে রনির মরদেহ সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়ে আছে।
নিহত রনি প্রামাণিক বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের পঞ্চদাশ গ্রামের মৃত দিলবর রহমান প্রামাণিকের ছেলে। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সাভারের উত্তর রাজাশন শহীদুলের বাড়িতে ভাড়ায় থেকে রিকশা চালাতেন।
নিহত রনির স্ত্রী শামীমা আক্তার ওরফে সাথী জানান, শনিবার দুপুরে ইভানের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে রনি অটোরিকশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। পৌনে ৫টার দিকে রাজাশন-রিরুলিয়া রোডের জিকে গার্মেন্টসের সামনে দিয়ে যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। পুলিশের ছোড়া গুলি রনির বুক ভেদ হয়ে বের হয়ে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সাথী বলেন, রনির লাশ বাসায় আনার পর ডেথ সার্টিফিকেট আনতে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ডেথ সার্টিফিকেট দেননি। তারা বলেছেন, রনির ডেথ সার্টিফিকেট সাভার মডেল থানা থেকে সংগ্রহ করেন। মেডিকেল থেকে কোনো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না।
নিহতের বোন শিল্পী আক্তার বলেন, আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে কোনো আন্দোলনেও যায় নাই। তবুও পুলিশ তাকে কেন গুলি করে মারল? কেন এই ফুটফুটে শিশু দুটিকে এতিম করল? আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
বয়োবৃদ্ধ শেখ শামীম (৬৫), পেশায় শরবত বিক্রেতা। সাভারের সড়ক-মহাসড়কে আন্দোলনের কারণে বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। ২০ জুলাই বিকালে একদল পুলিশ বাসায় ঢুকে ঘুমন্ত শামীমের গলার উপরে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই বয়োবৃদ্ধ শামীম মারা যান।
নিহত শামীম হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার শীমীলগর গ্রামের বাসিন্দা। সে সাভার পৌর এলাকার জ্বালেশ্বর-সোবহানবাগ মহল্লার হাজী আবদুল আজিজের বাড়িতে ভাড়ায় থেকে সাভারের বিভিন্ন স্থানে শরবত বিক্রি করতেন।
নিহত শামীমের প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া বৃদ্ধ খুদেজা বেগম বলেন, বিকালের দিকে আমি রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ একদল পুলিশ পাশের (শামীমের) বাসায় ঢুকে। তখন শামীম ঘরে ঘুমাচ্ছিল। পুলিশ তার কক্ষে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষটাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নিহতের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফয়জুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হঠাৎ তাদের বাসার ভেতর ঢুকে বড় ভাই শামীমের মুখ ও থুঁতনিতে তিনটি গুলি করে। ঘুমন্ত অবস্থাই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। পরে তার লাশ আমরা দেশের বাড়িতে দাফন করে আসি।
প্রতিবন্ধী কুরবান শেখ (৫২) পায়ে সমস্যার কারণে ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে রাজ্জাক কাঁচাবাজারে তার মুরগির দোকানে যেতেন। ২০ জুলাই ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকায় তিনি দোকান খুলেছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশ ওই মার্কেটে ঢুকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে কুরবান শেখ মারা যান।
নিহত কুরবান শেখের ছেলে রমজান শেখ যুগান্তরকে বলেন, কারফিউ শিথিলের সময় দুপুরের দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় আব্বু দোকান বন্ধ করে পেছনের মাছবাজার এলাকার বরফকলের ভেতরে আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে আমার এক চাচাও আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। পুলিশ হঠাৎ বাজারে ঢুকে বরফকলের কাছে এসেও গুলি শুরু করে। বেলা পৌনে ২টার দিকে চাচা ফোনে জানান, আব্বুকে গুলি করেছে। এসে দেখি আব্বুকে রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন ধরে নিচ্ছেন। দ্রুত সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান বাবা আর বেঁচে নেই। আব্বুর বুকের বাঁ দিকে ও ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। মুখের বাঁ দিকে ছররা গুলির ক্ষত ছিল।
নিহত কুরবান শেখ রাজবাড়ি জেলার কালুখালী থানার পূর্ব রতন দিয়া গ্রামের মৃত মেহের শেখের ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে সাভার জালেশ্বর-স্মরণিকা এলাকার সুমন মিয়ার বাড়িতে ভাড়ায় থেকে সাভার কাঁচাবাজারে মুরগির ব্যবসা করতেন।
কুরবানের সঙ্গে বরফকলে আশ্রয় নিয়েছিলেন জনির দোকানের কর্মচারী ফারুক (৪০)। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় ফারুকও। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ২১ জুলাই সকালে তিনি মারা যান।
নিহত ফারুক জামালপুর সদর থানার নয়াপাড়া ডেঙ্গারগর গ্রামের মৃত হায়দার আলীর ছেলে। তিনি সাভারের জালেশ্বর-স্মরণিকা নূর মোহাম্মদের বাড়িতে ভাড়ায় থেকে জনির মুরগির দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন।
১৯ জুলাই শুক্রবার জোহর নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন আলামিন (২৩)। বাসা থেকে বের হতেই গলির মধ্যে একদল পুলিশ দেখতে পায়। তিনি ফিরে বাসায় ঢুকার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এ সময় আলামিন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলামিন মারা যায়।
নিহত আলামিন কুমিল্লা জেলার ররুরা থানা এলাকার দৌলতপুর গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে। তিনি পরিবারের সঙ্গে সাভার রেডিও কলোনি রফিকের ভাড়াবাসায় থেকে স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন।
মেহেদী হাসান (২৫) ও আলামিন দুজনের সম্পর্ক শালা-দুলাভাই। তাদের উভয়ের পেশা রাজমিস্ত্রি। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় তারা দুজন ব্যাংক কলোনি থেকে কাজ শেষে হেঁটে ডেনমার্কেট এলাকায় বাসায় ফিরছিলেন। তারা বাজার রোডের আমিন টাওয়ারের সামনে পৌঁছলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় তিনটি গুলি মেহেদীর মুখে (চেহারায়) লাগলে সে ঘটনাস্থলে ছটফট করতে করতে মারা যায়।
নিহতের দুলাভাই আলামিন যুগান্তরকে জানান, দীর্ঘ সময় ধরে বাজার রোড পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম দুজন। এরপর মনে হচ্ছিল পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। দুজন হাত ধরে রাস্তা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা রাস্তায় পা রাখামাত্র বিকট শব্দে একযোগে কয়েকটি গুলির আওয়াজ পাই। আমি চিৎকার করে রাস্তার ওপাশে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়ি। স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমি চেতন হয়ে দেখি মেহেদীর লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। মেহেদীর মুখে তিনটি গুলির চিহ্ন রয়েছে।
মেহেদীর বাবা বাচ্চু সরকার বিলাপ করে বলেন, আমার ছেলে কোনো আন্দোলনে যোগ দেয় নাই। কোনো রাজনীতিও করত না। সে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিল। পুলিশ কেন তাকে গুলি করে মারল?
নিহত মেহেদী নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার বউরাকোনা গ্রামের মো. বাচ্চু সরকারের ছেলে। তিনি আড়াপাড়া এলাকার ডেনমার্কেট মহল্লার মজিবরের বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভাড়া থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
নবী নূর মোড়ল (৫০) তিনি বনপুকুর মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় বিশ বছরে বেশি সময় মাছ বিক্রি করতেন। শনিবার সন্ধ্যার পর মসজিদের পাশে একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে যান নবী নূর; পথিমধ্যে পুলিশের অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। নিহত নবী নূর মোড়ল বনপুকুর মসজিদ রোড সংলগ্ন নজরুল ইসলাম মল্লিকের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
নিহত নূর নবীর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে শনিবার সন্ধ্যায় সাভার বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় শুভশীল (২৩)। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন তিনি। শুভশীল সাভারের দক্ষিণপাড়া এলাকার বিকাশ শীলের ছেলে। সে পরিবার নিয়ে সাভার দক্ষিণপাড়ার রবি সাহার ভাড়া বাড়িতে থেকে চক্রবর্তী এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
মহিবুল (২৮) নামের এক বাসের হেলপার ২১ জুলাই রোববার দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাভার সুপার মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সুপার মেডিকেল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সাভারের জাবাল-ই-নূর দাখিল মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছায়াদ মাহমুদ খান (১২)। তার বাসা সাভার মডেল কলেজ সংলগ্ন চাপাইন রোড়। রাস্তার লোকজনের হইহুল্লোড় শব্দ পেয়ে সে দেখতে আসে। পুলিশ পিকেটারদের লক্ষ্য করে গুলি করলে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। মানুষের চাপে ছায়াদ তার বাসায় ঢুকতে পারেনি। এ সময় পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। নিহত ছায়াদ মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার ধল্লা-খানপাড়া গ্রামের বাহাদুর খানের ছেলে।
ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন (২৩) সাভার বাসস্ট্যান্ডের মুনসুর মার্কেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়ামিনের দুই সহযোদ্ধা (আন্দোলনকারী) জানান, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন প্রতিহত করতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সঙ্গে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা শতাধিক অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মহড়া দেয়। এ সময় পিকেটারদের একটি ইটের অংশ সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের হাতে লাগে। এরপর সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে আমাদের ধাওয়া দেয়। এ সময় ইয়ামিনকে তারা ধরে ফেলে। পরে তার বুকে শটগান ঠেকিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এতে ইয়ামিন ঘটনাস্থলেই মারা যান।
নিহত ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমার ছেলেকে যে কায়দায় যারা মেরেছে তার কয়েকটি ভিডিও চিত্র আমার কাছে এসেছে। ইয়ামিনের মরদেহটি তারা আলুর বস্তার মতো রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেলছে। এর চাইতে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। এ নির্মম হত্যার বিচার কেউ করতে পারবে না। আল্লার কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি। আশাকরি আল্লাহ এর বিচার করবেন।
হতাহতের বিষয়ে সাভার মডেল থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেছেন, সাভারে হতাহতের কোনো ঘটনা নেই। তবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঢাকা জেলায় ১৯টি মামলায় আড়াইশ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।